কলমাকান্দার নদ-নদী
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতই কলমাকান্দা উপজেলাও নদ-নদী আর হাওর বিধৌত। কলমাকান্দায় অনেকগুলো নদী প্রবাহমান। কলমাকান্দার নদীগুলো তাদের নামকরণের মতই বৈচিত্রময়। এখানে একই নদীকে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকার প্রবণতা রয়েছে। এমনকি কোন নদীর মাত্র ২/৩ কিমি দৈর্ঘ্যের অংশকেও এর উজানের নামের থেকে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। এ উপজেলার উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হল সোমেশ্বরী, আত্রাখালী, গণেশ্বরী, ধলেশ্বরী, উব্দাখালী ইত্যাদি। এ নদীগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি নদী হলঃ
সোমেশ্বরীঃভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার ধারা আরো কয়েকটি স্রোতধারার সাথে মিলিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর উৎপত্তি। এর পূর্ব নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত।তাদের বলা হতো'পাটুনি'।তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো।বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না।কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল।১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা ইত্যাদি তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন।ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা।নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ এলাকাটি মুখর থাকত।এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে।তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এ স্থানটিই উত্তম।সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন।ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে।সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ।ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে।সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ।সোমেশ্বর তার আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে।এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন'সুসং রাজ্য'।এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে।ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত।তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন।তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের 'ভৃঙ্গার' থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী।তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা 'সমসাং' বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে।সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে।এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী।সেদিনের সেই সোমেশ্বরী নদীই বর্তমান নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার ভেতর দিয়ে অবিরাম বয়ে চলেছে।সোমেশ্বরী নদীর বর্তমান প্রধান স্রোতটি জারিয়ার কিছু উত্তর-পশ্চিমে চিতলির হাওর হয়ে জারিয়ার নিকট ভূগাই-কংস নদীতে মিলিত হয়।আর পুরাতন ধারাটি কুমুদগঞ্জ, বড়ইউন্দ, সিধুলী, কলমাকান্দা ও মধ্যনগর হয়ে ধনু নদীতে পড়েছে।সোমেশ্বরীর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪০ মাইল।সোমেশ্বরী নদীর তীরে কলমাকান্দা উপজেলা সদর অবস্থিত এবং অববাহিকার প্রথম অংশ পার্বত্য, মধ্য অংশ মোটামুটি সমতল ও উর্বর এবং শেষাংশ নিচু এলাকা।
আত্রাখালিঃদুর্গাপুর সদরের নিকটে সোমেশ্বরী থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন বিল যেম নাগাভাগার মত বিভিন্ন ছোট-বড় বিল পেরিয়ে নাজিরপুর বাজারে মিলিত হয়েছে ছয়টিক্কা নামক আরেকটি নদীর সাথে।বর্ষা মৌসুমে এ নদী টইটম্বুর থাকে।চলাচল করে দাঁড়টানা ও ইঞ্জিনের নৌকা।দুর্গাপুর থেকে নাজিরপুর পর্যন্ত যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করা হয় এ নদীর মধ্য দিয়ে।বর্ষাকালে এ নদী পরিণত জেলেদের মৎস্য আহরণের উপযুক্ত স্থানে।এ সময় এ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
গণেশ্বরীঃগণেশ্বরী নদীটি কলমাকান্দা সদরের নিকট উব্দাখালী নদীতে এসে মিশেছে।বর্ষাকালে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে নদীর দুকূল।এ সময় এ নদীতে চলাচল করে নৌকা ও লঞ্চ।লেংগুরা বাজার থেকে কলমাকান্দা সদর পর্যন্ত সৃষ্টি হয় যোগাযোগের নতুন পথ।স্থানীয় প্রশাসন এ নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে বোরো চাষের ব্যবস্থা করে থাকে।
ধলেশ্বরীঃমেঘালয়ের পাহাড় থেকে ফুলবাড়িয়া, জিগাতলা, রাধানগর প্রভৃতি গ্রাম হয়ে এ নদী গিয়ে পড়েছে নাগাভাগা বিলে।বর্ষাকালে এ নদীর দুকূল ছাপিয়ে স্রোত প্রবাহিত হয়।আর শীতকালে হেটে চলে মানুষ; পার হয় সাইকেল, রিকশা, মোটর সাইকেল।তবে এ নদীর স্বচ্ছ পানির প্রবাহ থাকে সারাবছর।শীতকালে চাষীদের বোরো ধানের চাষ সম্ভব করে এ নদীর পানি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস